ভাষাবিদরা বলে ভালোবাসার বিপরীত শব্দ ঘৃণা করা, কিন্তু আমি বলি ভালোবাসার বিপরীত শব্দ অবহেলা করা।
আর অবহেলা বড় মারাত্মক প্রতিক্রিয়াশীল একটা জিনিস। অবহেলা একজন মানুষকে তার সমাজ ও পরিবার থেকে কতটা দূরে ঠেলে দিতে পারে তা একটু গভীরভাবে ধ্যান করলে বুঝতে পারবেন।
মানুষ যখন তার খুব কাছের মানুষগুলোর দ্বারা অবহেলার শিকার হয় তখন সে সারা পৃথিবী ভালোবাসা খুঁজে বেড়ায়।
অবহেলা একজন মানুষকে মানসিক বন্দি বানিয়ে দেয়। অবহেলার ফলে মানুষ স্বপ্ন দেখার শক্তি হারিয়ে ফেলে।
এই অবহেলার শিকার হয়ে আমি সারাটা জীবন এক মানসিক কারাগারে বন্দী হয়ে আছি। শুধু মাঝখানে দুই বছরের জন্য প্যারোলে মুক্তি পেয়েছিলাম। কারাগারের বন্দিরা তবুও বন্দি অবস্থার মুক্তি পাওয়ার পর নতুন করে সুন্দর জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখতে পারে। কিন্তু মানসিক বন্দীরা কোনো স্বপ্ন দেখতে পারেনা। রান্নাঘরে ধোঁয়া হলে যেমন শ্বাস নিতে কষ্ট হয় তেমনি মানসিক বন্দীদের কাছে জীবনটাও শ্বাসকষ্টময় মনে হয়।
পানি পানি সর্বত্র পানি, কিন্তু পান করার মতো একফোঁটা পানিও নাই। মানসিক বন্দীদের জীবনটা হলো এমন, স্বপ্ন স্বপ্ন এত স্বপ্ন, কিন্তু বাস্তবায়ন করার মতো কোনো স্বপ্ন নেই; কারণ তার কোনো সাপোর্ট নেই, সে অবহেলার শিকার।
অবহেলিত হলে একজন মানুষের নিজেকে খুবই অসহায় মনে হয়। এই অবহেলিত মানুষটা যখন বুকে কষ্ট চেপে নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন সে কেমন হবে সেটা পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে। দুঃসময় মানুষের আজীবন থাকে না, কিন্তু দুঃসময়ের অবহেলাগুলোর কথা আজীবন মনে থাকে।
অবহেলার ফলে সৃষ্ট কষ্টগুলো একজন মানুষকে পরিবারবিমুখ ও সমাজবিমুখ করে দেয়।
আমার এসব বলার উদ্দেশ্য নিজের অসারতাকে তুলে ধরা নয়, এর উদ্দেশ্য মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া জুনিয়রদের সতর্ক করা। কয়েল জ্বালানোর উদ্দেশ্য মশা তাড়ানো, কয়েল জ্বালানোর উদ্দেশ্য ধোঁয়া সৃষ্টি করা নয়, কিন্তু এতে ধোঁয়া সৃষ্টি না করে যেমন মশা তাড়ানো যায়না তেমতি এসব উদাহরণ না দিয়ে বিষয়টাকে উপস্থাপন করা সম্ভব হচ্ছেনা।
এখন বিষয় হলো, মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা কীভাবে বুঝবে যে লাইফে সফলতা আসতে বিলম্ব হলে পরিবার একসময় অধৌর্য হয়ে সাপোর্ট দেওয়া বন্ধ করে দেবে ও সর্বোচ্চ লেভেলের অবহেলা করবে।
হ্যা, কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যেগুলো কোনো পরিবারে থাকলে বুঝবে একদিন সেই পরিবার তোমাকে হেয় করবে ও তুমি অবহেলিত হবে।
তাই আমার জুনিয়রদের বলি, 'তোমরা সতর্ক হও, আমার মতো সমস্যা তোমাদের কারও আছে কিনা মিলিয়ে দেখো'—
১. ঘটনা যাই ঘটুক তা তোমার দোষ হিসেবে মূল্যায়ন করা হবেঃ বিষয়টা একটু ক্লিয়ার করি। কোনো কাজে কেউ সফল না হওয়ার পেছনে নিজের দোষ কিংবা অদক্ষতা ছাড়াও আরও বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। কোনো দুর্ঘটনার কারণে কেউ কোনো কাজে ব্যর্থ হতে পারে। দুর্ভাগ্যের কারণেও কেউ কোনো কাজে ব্যর্থ হতে পারে, আবার সেই কাজ করতে গিয়ে কোনো প্রবলেম এর কারণেও সে সেই কাজে ব্যর্থ হতে পারে। আবার কোনো বিশেষ কারণেও সে সেই কাজে ব্যর্থ হতে পারে।
এক্ষেত্রে ন্যারো মাইন্ডের মূল্যায়ল হলো ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান না করে দুর্ঘটনা, দুর্ভাগ্য, প্রবলেম, বিশেষ কারণ যাহাই ঘটুক না কেনো সবকিছুকেই তার দোষ হিসেবে মূল্যায়ন করা।
২. তোমার ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো উপেক্ষিত হবেঃ ফ্যামিলি যদি সবসময় আত্মীয়স্বজনের উৎসবাদি ও ফর্মালিটি নিয়ে ভাবাছন্ন থাকে। তোমার ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো নজর এড়িয়ে যায় ও উপেক্ষিত হয় তাহলে বুঝবে চূড়ান্ত পর্যায়ে যেটা হবে সেটা হলো একসময় তারা তোমাকে ও তোমার স্বপ্নকে এড়িয়ে যাবে ও জীবনে সফলতা আসতে বিলম্ব হলে তারা তোমাকে সাপোর্ট দেওয়া বন্ধ করে দেবে।
৩. অন্যখানে উদ্ভব হওয়া রাগের প্রভাব তোমার উপর এসে পড়বেঃ যদি দেখতে পাও যে পরিবারের কর্তার এরূপ একটা উদ্ভট স্বভাব আছে তা হলো মাঠে বা অফিসে কোনো বিষয় নিয়ে তার রাগ উৎপন্ন হয়েছে এবং তা সে সেখানে দেখাতে না পেরে তা সেখানে চেপে রেখে বাড়িতে এসে পরিবারের লোকজনদের সাথে অযথাই রাগারাগি করছে তাহলে বুঝে নেবে সেই ফ্যামিলিতে তোমার ভবিষ্যৎ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
৪. তোমার অবর্তমানে তোমার মূল্যবান জিনিসপত্র অযত্নে অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাবেঃ দীর্ঘদিন বাইরে থাকার ফলে যদি দেখতে পাও বাড়িতে তোমার মূল্যবান জিনিসপত্র অযত্নে অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে, তোমার রাখা বইপুস্তক ছুঁচো ইঁদুর-উঁইপোকায় খেয়ে ফেলছে; তাহলে বুঝবে একসময় যখন তোমার সৃজনশীল উদ্যোগ সফলতার খুব কাছে, আরেকটু সাপোর্ট দরকার ঠিক সেই সময়টাতে তোমার সাপোর্ট পাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে।
৫. তোমাকে সন্তানের মতো নয়, নিজ বাড়িতে শরণার্থীর মতো জীবন যাপন করতে হবেঃ তুমি যদি নিজ বাড়িতে সন্তানের মতো বেড়ে উঠার পরিবেশ না পেয়ে শরণার্থীর অবস্থানের মতো পরিবেশ পাও; কোনো হেতু ছাড়াই এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবেনা তাহলে বুঝে নিও তুমি সেই হতভাগা অবহেলিত সৃজনশীলদের দলে।
এখন বলতে হয়, তাহলে এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?
আসলে অবহেলার চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে এ থেকে পরিত্রাণের আর কোনো পথ থাকে না। তখন গ্রিক ট্রাজেডিই লাইফের প্রতিচ্ছবি।
তাই মধ্যবিত্তের সন্তানদের অল্প বয়সেই বাস্তবতার জ্ঞান লাভ করা জরুরি। শিক্ষক সমাজের উচিৎ হবে তাদেরকে দিবাস্বপ্ন না দেখানো। আর শিক্ষাব্যবস্থার গবেষকদের উচিত হবে স্কুলের জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষামূলক বইগুলোর ফেমিলার ভার্সন না দিয়ে মধ্যবিত্তদের জন্য স্পিসিফিক ভার্সন করে দেওয়া। সরকার অবশ্য তা করবে না, তাই আমার "সচেতনতার পাঠশালা" এর মাধ্যমে আমি তা করে যাবো।
No comments:
Post a Comment