বলতে পারেন মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা কী?
ব্যবসায় বড় ধরণের লস হওয়া? এক্সিডেন্ট হয়ে কয়েকমাস কোমায় থাকা? ইত্যাদি ইত্যাদি?
না কোনোটাই নয়। মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা হলো— ভুল বিশ্বাস নিয়ে জীবন চালানো।
বিষয়টা পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করি— আমার দুর্দশার উদাহরণটাই হতে পারে একটি অন্যতম উদাহরণ।
বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন আমি কোনো অহেতুক সময় নষ্ট করতাম না। সবসময় কিছু না কিছু শিখতাম ও শেখার কাজে লেগে থাকতাম। আমি তিন বছর শুধু বিভিন্ন জিনিস শিখেই সময় কাটাই। আর আমার একটা বিশ্বাস ছিল যে, পড়াশুনা শেষ করে চাকরি না হলেও নিজেই একটা কিছু করতে পারবো।
এমন কিছু দক্ষতা অর্জনের পর আমি বাকি কিছু সময় ব্যয় করলাম সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নেওয়ার কাজে।
যাহোক পড়াশুনা শেষ করে নিজে কিছু করার জন্য সাপোর্ট পাওয়া দূরে থাক বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষা দেওয়ায় জন্য যে ঢাকায় যাতায়াত করবো সেই টাকাও ফ্যামিলি থেকে পাচ্ছিনা। আত্নীয় স্বজনদের একটা অংশ আমার জন্য বিশেষ পরামর্শ প্রকল্প খুলে বসেছে এবং তাদের প্রতিবেদনের পরামর্শ হলো কোম্পানির চাকরিতে জয়েন করো।
এর আগেই বলেছিলাম বাঙালির বৈশিষ্ট্য হলো কোনোকিছু না জেনে না বুঝেই বা ১০% জেনেই তাতে কমেন্ট করা; অনেকটা সেই কয়েক অন্ধের হাতি দেখার গল্পের মতো। আমি বংশগত সুত্রে কিছু বংশগত ও পরিস্থিতিগত রোগ উপহার পেয়েছি। যেমন- আমার মায়ের অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া ও তার কারণে অকালে গর্ভধারণের জন্য আমার চোখের সমস্যা; চশমা ছাড়া ভালো দেখিনা। সেইসঙ্গে বংশগত সুত্রে উপহার পেয়েছি এলার্জি রোগ; রোদে অল্প একটু গা ঘামলেই সারা শরীর চুলকায়। আমার দাদার কাছ থেকে উপহার পেয়েছি তার হ্যালোজিনেশন ও শর্ট টাইম মেমোরি লসিং নামক ব্রেইন এর রোগ। আমার ঢাবিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের চাঞ্চ ফসকে গেছে এই শর্ট টাইম মেমোরি লসিং ও হ্যালোজিনেশন রোগের কারণে। এছাড়াও পেয়েছি দীর্ঘকালীন আমাশয়। আর মাতৃ তরফ থেকে উপহার পেয়েছি উচ্চমাত্রার গ্যাস্ট্রিক এবং একটি হরমোনঘটিত রোগ।
একজন মানবিকের ছাত্র হিসেবে আমার জন্য কোম্পানির চাকরিতে যেসব অল্প কিছু কাজ আছে সেসব আমার বডি ক্যাপাসিটির সঙ্গে সুইট করে না।
নিজের গল্প নিয়ে হয়তো মূল টপিক হারিয়ে যাওয়ার মতো মনে হতে পারে। যাহোক, আমার বিশ্বাস ছিল আমার ফ্যামিলি আমার পাশে থাকবে। আমার এই বিশ্বাসের জন্ম হয় কারণ আমার পাশে দাঁড়ানোর মতো সামর্থ্য ও সম্পদ আমার পরিবারের আছে। কিন্তু এই ভুল বিশ্বাসই আমার জীবনে অলীতভার্সা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমার গ্রামে সালমা ও সীমা নামে দুই বোন আছে। তারা এইচএসসি থেকে গার্মেন্টসে কাজ করে টাকা জমিয়েছে, এখন চাকরি ছেড়ে দিয়ে সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছে। অবশ্য সালমা ফুফু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাঞ্চ পাওয়ার পর চাকরি ছেড়ে টিউশনি করাতেন; এখন বরসহ দুজনেই টিউশনি করেই চলেন ও প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আর সীমা ফুফু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন বলে চাকরিটা রান করেছিলেন।
এখন এটা নিয়ে একটা উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে— তারা মেয়ে হয়ে পারলে আমি কেনো পারবো না?
বিষয়টা হলো, তাদের বাবা উদাসীন ছিলেন তাই জীবনে কী করতে হবে এই বিষয়টা তাদের কাছে পরিষ্কার ছিল; সেই মোতাবেক তারা করেছে।
আমার ফ্যামিলি যদি উচ্চমধ্যবিত্ত না হয়ে দরিদ্র হতো তাহলে এই ভুল বিশ্বাস আমার মাঝে জন্ম হতোনা। তখন আমি সেই মোতাবেকই সবকিছু প্রস্তুত করে নিতাম। কিন্তু এই ভুল বিশ্বাসটা সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিল।
কয়েকদিন একটা স্কুলে অস্থায়ী শিক্ষক হিসেবে ছিলাম। অষ্টম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাসে গল্প করা অভ্যাসের কারণে ক্ষেপে গিয়ে তাদেরকে বেশকিছু এন্টিবায়োটিক দিয়েছিলাম।
তাদেরকে বলেছিলাম,——— "নিজের দুর্দিনের জন্য এখনই প্রস্তত হও। সায়েন্সের ছাত্র হলে পড়াশুনায় এক্সিলেন্ট হও। কোনো কিছুকে ফাইভ স্টার সিস্টেম দিয়ে মার্ক করা যায় যেখানে ৫ স্টার মানে এক্সিলেন্ট, ৪ স্টার মানে গুড, ৩ স্টার মানে মোটামুটি, ২ স্টার মানে নিম্নমানের আর ১ স্টার মানে খারাপ। আর এই প্রতিযোগিতার যুগে ভালো হয়েও কাজ হবে না, হতে হবে এক্সিলেন্ট। আর এক্সিলেন্ট হলে তুমি বিভিন্ন কোচিংয়ে ক্লাস নিতে পারবে যা তোমার দুর্দিনের সঙ্গী হবে।
আর মানবিক এর ছাত্র হলে সেই সুবিধা সীমিত। তবে তাদের একটা সুবিধা হলো যেহেতু পড়াশুনার চাপ কম তাই সময় করে কিছু কিছু কাজ করে টাকা জমাও ও টাকা জমিয়ে কম্পিউটার কিনে কিছু কাজ শিখে রাখতে হবে— গ্রাফিক্স ডিজাইন, ভিডিও এডিটিং ইত্যাদি ইত্যাদি, যা তোমার দুর্দিনের সঙ্গী হবে।"
আরেকটা কথাও বলেছিলাম, "তোমরা কি ভাবছো তোমাদের বাবা-মা তোমাদেরকে এখন যেরূপ ভালোবাসে এই ভালোবাসা সবসময় একই রকম থাকবে?
মোটেও না। প্রকৃতির অন্য জিনিসের মতো এই ভালোবাসাও একসময় জীর্ণ শীর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এটা তাদের দোষ নয়, এটা একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার। একজন নতুন ডাক্তার যখন তরুণ বয়সে তার প্রাকটিস শুরু করে তার তখনকার লেখা একটা প্রেসক্রিপশন ও তার ২৫-৩০ বছর পরে লেখা আরেকটা প্রেসক্রিপশন পাশাপাশি রেখে দেখলে তুমি বিশ্বাসই করতে পারবে না যে এ দুইটা একই ব্যক্তির লেখা। এটা সে ইচ্ছা করে করেনি, প্রাকৃতিক কারণেই হয়ে গেছে। মানুষ বৃদ্ধ হলে তার চামড়া ঢিলে হয়ে যায়। এটা সে প্রতিদিন একটু একটু করে টেনে চামড়া ঢিলে করেনি, এটা প্রাকৃতিক কারণেই হয়ে গেছে। ভালোবাসাও প্রাকৃতিক কারণে জীর্ণ শীর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়। ভালোবাসা কোনো ধ্রুব বিষয় নয়, এটা আপেক্ষিক বিষয়।
তাই বলতে হয় জগতে ভালোবাসা বলে কোনোকিছু নেই; এখানে সবকিছুই চলে হিসেব নিকেশ করে। তোমাদের বাবা-মা এখানে তোমাদেরকে পাঠিয়েছে তাদেরও একটা হিসেব নিকেশ আছে। সেই হিসেব নিকেশের বাইরে একটা কিছু করে দেখিও তোমাকে জুতত রাখে নাকি?
জীবনের একটা সময়ে এসে তোমরা প্রেমে পড়বা এবং তখন থেকেই তোমাদের জীবনের সংকটের অধ্যায় শুরু হবে যেটা তোমার একান্ত নিজের সমস্যা।
একটি রূঢ় বাস্তবতা হলো— নিজের একান্ত দুর্দিনে কাউকেই পাশে পাওয়া যায় না। বাবা-মা, অমুক মামা, অমুক খালু, অমুক আঙ্কেল, অমুক ভাই-তমুক ভাই, অমুক বন্ধু-তমুক বন্ধু কাউকেই তখন পাশে পাওয়া যায় না। তাদের অনেকে আবার নিজে সরাসরি "না" না বলে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে উধাও হয়। দরকারের সময় তাদেরকে হ্যাজাক লাইট লাগিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না।
তাই নিজের কর্মদক্ষতাই দুর্দিনে টিকে থাকার একমাত্র হাতিয়ার। দুর্দিনে মানুষ নিজেই তার একমাত্র বন্ধু, একমাত্র সহযোগী। তুমি যতো ছোট কাজই করোনা কেনো সেটাই হয় একমাত্র অবলম্বন— তা তুমি কাপড় লন্ড্রি করা, চুল-দাড়ি কাটা, রাজমিস্ত্রির সহকারি হিসেবে কাজ করা, রঙমিস্ত্রির কাজ করা, পাইপলাইনের মেকানিক হওয়া যাই করোনা কেনো।"———
ছোটোবেলা থেকে বইপুস্তকে কিছু ভুয়া কথাবার্তা আজ আমাকে এই অবস্থানে এনে দিয়েছে। মাতৃস্নেহ.........। পরিবারের মতো আর........। এটা সেটা বাড়িয়ে বলা কথাগুলো আমার ভুল বিশ্বাসের ভিত্তি গড়ে তুলেছিল।
তাই পাঠ্যপুস্তকের এসব অতিরঞ্জিত কথাবার্তা সংশোধন করা প্রয়োজন। বাস্তবতার নিরপেক্ষ জ্ঞান দেওয়াই সর্বোত্তম পন্থা।
আমার অনেক দোষ থাকলেও মানুষের টাকা মেরে দেওয়া, মিথ্যা বলা, নেশা করা, স্বার্থপরতা, হিংসা, অহংকার— এসব দোষ নাই। তারপরেও আমি ইন্টারমিডিয়েটে সত্যিই এ+ পেয়েছি নাকি ভং মেরেছি তা আমার এক মামা রোল নাম্বার নিয়ে রেজাল্ট চেক করে দেখেছিল।
অনার্স শেষের সময় একবার আমার হরমোনজনিত সেই রোগটা এতটাই বেড়ে গেলো যে, চারতলায় আমার ডিপার্টমেন্টে উঠতে হলে তারমাঝে দোতলায় উঠার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে হয়। কারণ পায়ের রগ কুঁচকে যায়। তখন আমি অসুস্থ মানুষটাকে মামারা পরামর্শ দিল, কোম্পানিতে চাকরি করে বেতন তুলে চিকিৎসা হতে।
মনে হয় আমি কতটা অবহেলিত তা বুঝাতে এর বেশি আর কিছু বলতে হবে না।
পরিবার, সমাজ, একটি মন্দ ভাগ্য এবং বংশগতসুত্রে উপহার পাওয়া কিছু বংশগত রোগ আমার জীবনটাকে এতটাই বিষিয়ে তুলেছে যে সায়ানাইডের বিষ এর কাছে নস্যি; কারণ সায়ানাইড একবারে মারে, আর এসব আমাকে ক্ষয়ে ক্ষয়ে মারছে।
আমার মাঝে একটা জ্যোতিষীর মতো বৈশিষ্ট্য আছে। অনেক কিছু আমি আগে থেকেই টের পেয়ে যাই। আমার যে আজ এই অবস্থা হবে তা আমি অনেক আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। তাই আমার ইন্টারমিডিয়েট এর মেসের মালিকের ছেলেকে বলেছিলাম, "আপনারা তো পাইপলাইন পরিষ্কারের কাজ করে নেন, আমাকে সেই পাইপলাইন মেকানিকদের ফোন নাম্বার দিন, আমি তাদের সাথে কাজ করবো ও কিছু টাকা সঞ্চয় করবো"। সে ছিল ফ্রিল্যান্সিং এর টিচার। সে আমাকে তার মেসের অন্যতম ভালো ছাত্র হিসেবে চিনতো। তাই সে আমাকে বললো— "এসব কাজ তুমি কেনো করবে? তুমি একটা ল্যাপটপ কিনে আমার কাছে আসিও, আমি কাজ শিখে দিবো তুমি এর চেয়েও অনেক ভালো আয় করবে। কিন্তু তখন পরিবার আমাকে সাহায্য করেনি; ব্যাংকে টাকা জমিয়ে রেখেছিল তবুও আমার জন্য ব্যয় করেনি। এই সময়ে আমি আরেকটা ফাঁদে পড়লাম। আমার মামা আমাকে তার কম্পিউটার অস্থায়ীভাবে ব্যবহার করার জন্য দিলেন। যেহেতু সেটা ডেক্সটপ ছিল তাই আমি সেটা নিয়ে সেই প্রশিক্ষক এর কাছে যেতে পারলাম না। ফলে আমার কোনো শিক্ষক থাকলো না, আমি তার কাছে এবং এর ওর কাছে একটু একটু করে শুনে এসে ও বই পড়ে সেসব শিখতে লাগলাম। যেহেতু শিক্ষক নাই তাই একা একা শিখতে বেশ সময় লেগে গেল। যাহোক যখন অনেক কিছু শিখে গেলাম তখন আমার মামা কম্পিউটারটা ফেরৎ নিলেন। তাই সেটা ভেস্তে যায় আর তার পরেই কিছু লোকের মোটিভেশনে গলে গিয়ে BCS প্রিপারেশন শুরু করলাম। যার শেষে ফলাফল দাঁড়ালো এই। মানুষ কোনোকিছু না জেনেই পরামর্শ দেয়। তাই বাদবাকি জীবনে আর অন্যের পরামর্শ শুনছি না। নিজের বিশ্বাস থেকে কাজ করে যাবো।
আমি জীবনে কিছু করতে পারি আর নাই পারি এরূপ ভুল বিশ্বাস নিয়ে জীবন চালানোর বিষয়ে তরুণ প্রজন্মকে সতর্ক করে তুলতে পারলেই এটাকে সফলতা মনে করবো।
No comments:
Post a Comment