দুঃসময় হলো মানুষের জীবনে বাস্তবতাবোধ অর্জনের সময়। এই সময়ে আশেপাশের মানুষের আসল রূপ চেনা যায় এবং এই অসহায়ত্বকে পুঁজি করে নিজের হীনস্বার্থ হাসিল করা মানুষগুলোকেও চেনা যায়। তবে এ বিষয়ে কিছু পূর্ব পরামর্শ নিয়ে থাকলে দুঃসময় পাড়ি দেওয়া সহজ হয়। বুদ্ধিমান মানুষেরা অন্যের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজের জীবনে সেসব ভুল করা থেকে বিরত থাকেন। তাই তোমার পরিচিত বিভিন্ন মানুষ দুঃসময়ে যেসব ভুল করেছিলেন বলে বেশি দুর্গতি ভোগ করেছিলেন সেসব তাদের কাছ থেকে জেনে নাও। তাহলে কিছু ট্রিকস্ পাবে। দুঃসময়ে কাজে দেয় এরূপ বেশকিছু ট্রিকস রয়েছে। নিম্নে সেরূপ কয়েকটি ট্রিকস্ এর বর্ণনা দিলাম।
১. কথার পোলারিশ দিতে শিখো—
বিষয়টা ব্যাখ্যা করার জন্য প্রথমে একটা গল্প বলি। আমি প্রাইভেট স্কুলে ক্লাস নিতাম। আমি প্রতিদিনই সাদা শার্ট পড়ে ক্লাসে যেতাম। এটা দেখে ছাত্রছাত্রীরা আমাকে প্রশ্ন করতো— স্যার, আপনি সাদা শার্ট ছাড়া অন্য কোনো কালারের শার্ট পড়েন না কেনো?
তখন আমি বলতাম, সাদা হলো সেবার প্রতীক- সেজন্য ডাক্তারদের পোশাক সাদা, সাদা হলো নিরহংকার ও সাম্যের প্রতীক সেজন্য- হাজিদের পোশাক সাদা, সকল ধর্মের ধর্মগুরুদের পোশাক সাদা এমনকি সকল ধর্মের মানুষ মারা গেলে তাদেরকে সমাহিত করা হয় সাদা পোশাক পড়িয়ে। সাদা হলো সততার প্রতীক, সেজন্য প্রবাদে আছে 'সাদা মনের মানুষ'। লাইফের শুরুতে পাওয়া প্রথম গিফট দুধের রঙও সাদা। সাদা একটি আদর্শের নাম, একটি ভালোবাসার নাম। তাই আমি সাদা শার্ট পড়ি। অন্যদিকে সেই স্কুলের প্রধান যখন আমাকে বলে— তুমি তো সাদা ছাড়া আর কোনো স্ট্যান্ডার্ড পোশাক পড়ো না, এরকম অভ্যাস নিয়ে তো তুমি কোথাও নিজেকে স্মার্ট হিসেবে তুলে ধরতে পারবে না, কোথাও মূল্যায়নও পাবে না।
তখন আমি বলতাম, 'স্যার, সাদা ছাড়া আর কোনো কালার আমার পছন্দ হয় না, সাদা আমার খুব প্রিয়'। কিন্তু আসল ঘটনা হলো সাদা শার্ট অল্প টাকায় কেনা যায়। পুরান মার্কেট থেকে ওষুধ তৈরির ল্যাবরেটরির ফার্মাসিস্টদের ব্যবহৃত খুব ভালো মানের সাদা শার্ট খুব অল্প দামে পাওয়া যায়।
তাই তোমার দুর্বলতা ঢাকার জন্য আসল ঘটনা চেপে রাখতে কথার পোলারিশ দিতে শিখো। কারণ তোমার দূর্বলতা অন্যের সুযোগ গ্রহণের পথ তৈরি করবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, "তুমি দরজা বন্ধ করে কাঁদো কিন্তু কেউ ডাকলে হাসিমুখে দরজা খুলো, নয়তো তোমার এই দুর্বলতা অন্যের সুযোগ গ্রহণের পথ তৈরি করবে"।
২. সহানুভূতি অর্জন করতে শিখো—
লাইফে কোথাও কোথাও খুব অবহেলিত হয়েছো। সেই বলে সবখানেই শুধু তোমার জন্য অবহেলাই রয়েছে তা না। তুমি সৎ থাকলে কোথাও না কোথাও থেকে হেল্প পাবে। সেজন্য মানুষের সহানুভূতি অর্জন করতে শিখো। যদি কখনও হঠাৎ নিঃস্ব হয়ে যাও তখন এটা বেশ কাজে দেয়। আর এক্ষেত্রে ট্রিকস্ হলো সবার কাছে সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টা করতে যাবে না। নিজের ষষ্ঠ ইন্দিয় ব্যবহার করে তাদেরকে টার্গেট করো যারা তোমাকে ফেরাবে না, শুধু তাদের কাছেই যাও; সব জায়গায় নিজের Appeal খুঁজতে যাবে না। একসময় আমি তথ্যযোগাযোগ ব্যবস্থায় স্বেচ্ছসেবামূলক কিছু জনকল্যানকর কাজ করেছিলাম। তা দেখে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং সেটাকে মিডিয়া হিসেবে কাজে লাগিয়ে অর্থ আয় করার জন্য তিনি আমাকে ইনভেস্ট করার জন্য টাকা ধার দিয়ে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমার প্রজেক্টে কোনো পার্টনার না থাকায় আমি সেই সহায়তা নিয়ে প্রজেক্টটাতে হাত দিতে পারিনি।
করোনার কারণে বাজে সময় পার করছি। এই সময়টাতে একটা কিছু করার জন্য তার হেল্প চেয়েছিলাম। হেল্প অবশ্য পাইনি; কারণ যে সময়টাতে তিনি স্বেচ্ছায় আমাকে উৎসাহ দিয়ে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন সেটা আর এখন এক সময় নয়, এর মাঝে উনার বাবাকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা করাতে হয়েছে এবং তিনি বাসাবাড়ির কাজসহ আরও কিছু কাজে হাত দিয়েছেন, এর উপরে আমাকে সাহায্য করার মতো অবস্থায় তিনি নেই।
আরও কিছু এরূপ মানুষের সাথে কমিউনিকেশন রাখা দরকার ছিল।
৩. দুর্ব্যবহার গায়ে মেখো না—
হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, 'দুঃসময়ে কোনো দুর্ব্যবহার গায়ে মাখতে হয় না'। এখানে গায়ে মাখা বলতে দুর্ব্যবহারের প্রতি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া করাকে বোঝানো হয়েছে, ঘটনাগুলো মনে না রাখার কথা বলা হয়নি; মনে রাখতে না চাইলেও এসব মনে থাকেই। দুঃসময় মানুষের আজীবন থাকে না, কিন্তু দুঃসময়ে দুর্ব্যবহার করা মানুষগুলোর কথা আজীবন মনে থাকে। এক্ষেত্রে পরামর্শ হলো দুঃসময়ে এসব দুর্ব্যবহারের প্রতি রিঅ্যাক্ট করতে যেও না কারণ এতে তোমার অহেতুক কিছু এনার্জি লস হয়ে যাবে। এসময়ে মন ঠাণ্ডা করতে প্রয়োজনে ভবিষ্যতে সেসব লোকের উপর প্রতিশোধ নিবে বলে তাদের লিস্ট তৈরি করে রাখো কিংবা থ্রি ইডিয়ট মুভির সেই প্রিন্সিপালের ছবিতে ডার্টের তীর নিক্ষেপ এর মতো করে কিংবা অন্য কিছু করে হলেও মন ঠাণ্ডা করো শুধু তাৎক্ষণিক তাদের সাথে রিঅ্যাক্ট করে নিজের এনার্জি লস করো না। মাথা ঠাণ্ডা রেখে তাদের দুর্বল সাইটগুলো অধ্যায়ন করে তাদের থেকে কিছু আদায় করার প্ল্যান করো ও তা কাজে লাগাও, শুধু রেগে যেও না এটাই হলো এক্ষেত্রে আসল ট্রিকস্।
৪. আলগা দরদে গলে যেও না—
কিছু লোক আছে যারা তোমাকে কোনো কঠিন কাজ করতে দেখলে এসে আলগা দরদ দেখাবে। এসব আলগা দরদে গলার দরকার নাই। কারণ ভালোবাসা থেকে অনেক কিছু পাওয়া যায় কিন্তু আলগা দরদ থেকে কিছুই পাওয়া যায় না। ভালোবাসা এবং আলগা দরদ দুইটা ভিন্ন জিনিস। আলগা দরদ দেখানো লোকগুলো তোমাকে দুই টাকা দিয়ে হেল্প করবে না। তারা হলো সুবিধাবাদী। তারা তোমার দুর্দিনে দুঃসময়ের সুযোগ নিয়ে তোমাকে কিছু হৃদয় ঠাণ্ডা করার মতো কথা বলে তারা তোমার মনে স্থান করে নিতে চায় যাতে ভবিষ্যতে তাদের অন্য কোনো কাজে তোমাকে দিয়ে দু'একটা কাজ করে নেওয়া যায়, এই হলো জগৎ। তাই যারা বাস্তব কথা বলে তাদের কথা শুনো। আলগা দরদে গলার দরকার নাই। এটা মনে রাখো যে এ জগতে সবাই সবকিছু স্বার্থের জন্যই করে থাকে। মানুষ ভালো কথা বললেও স্বার্থের কারণেই বলে থাকে। দেখবে পথেঘাটে ভিক্ষুকরা বলে থাকে "এ দুনিয়ার এক টাকা দান করিলে আখিরাতে সত্তুর টাকা পাওয়া যায়"; এই কথা বলার উদ্দেশ্য কিন্তু মানুষজনকে দানখয়রাতের মাহাত্ম্য সম্পর্কে জানানো নয়, এর উদ্দেশ্য হলো সে যাতে এই কথাটা বলে সহজে কিছু দান পায়। এটা সে নিজের প্রয়োজনেই বলেছে, হাদিস প্রচারের জন্য বলে নাই। তাই বাস্তববাদী হও; আলগা দরদ দেখানো মানুষগুলোর সুন্দর কথা শুনলেই তাতে মুগ্ধ হওয়ার দরকার নাই।
৫. ধান্দাবাজদের ঝুঝতে শিখো—
যখন তুমি হ্যাজাক লাইট লাগিয়েও তোমার কোনো কাজের জন্য পার্টনার পাও নাই এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর 'একলা চলো রে' কথাটার উপর ভিত্তি করে এগিয়ে যাওয়া শুরু করেছো এবং তোমার কোনো কাজের সম্ভাবনাময় অগ্রগতি দেখার পর হঠাৎ তোমার কোনো বেকার বন্ধু এসে যদি বলে তোর উদ্যোগটা অনেক দারুণ রে, তুই তো পার্টনার খুঁজতেছিস, আমি তোর পার্টনার হবো কিংবা আমিও তোকে এই কাজে হেল্প করবো। তবে আমি একটা সমস্যায় আছি আমাকে একখানে যেতে হবে কিন্তু এই মূহুর্তে কাছে টাকা নাই, আমাকে দু'একহাজার টাকা ধার দে, আমি ফিরে এসে তোকে টাকাটা দিবো আর তোর সাথে কাজ করবো/ তোর কাজে হেল্প করবো। এখন তুমি যদি তোমার পকেট থেকে তাকে টাকা দাও তাহলে তোমার পকেট কিছুটা খালি হলো কিংবা যদি অন্যের কাজ থেকে ধার করে দাও তাহলে তুমি তার জন্য আরেকজনের কাজে ঋণগ্রস্ত হয়ে গেলে। কারণ সে আর তোমার কাছে ফিরেও আসবে না, তোমার সেই টাকাও ফেরৎ দিবে না। সে এসেছিলই তোমার উপরে তার ধান্দা প্রয়োগ করে তোমার দুর্দিনে তোমাকে মরার উপর খাঁড়ার ঘা দিয়ে তার নিজের হীনস্বার্থ হাসিলের জন্য। তাই শক্ত হও। এরূপ বন্ধুকে কৌশলে তোমার কাছ থেকে বিদায় করো।
৬. চকলেট থিওরির পরামর্শ গ্রহণ করো না—
যদি একই বিষয়ে একজন তোমাকে একটা সহজ পরামর্শ তথা শটকার্ট পদ্ধতি দেয় এবং আরেকজন একটা কঠিন পরামর্শ তথা সময়সাপেক্ষ পদ্ধতি দেয় তাহলে তুমি আরও কয়েকজনের কাছে গিয়ে বিচার করে দেখো যে সহজ পরামর্শটি আসলেই কোনো ভালো পরামর্শ ছিলো নাকি সেটা চকলেট থিওরির পরামর্শ ছিলো। সেটি বাস্তবিকই ভালো পরামর্শ হলে তা গ্রহণ করো, আর সেটি যদি চকলেট থিওরির পরামর্শ হয়ে থাকে তাহলে সেটি বর্জন করে কঠিন পরামর্শটি গ্রহণ করো।
'চকলেট থিউরি বনাম বাস্তবতা' বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করি। কিছু কিছু শিক্ষক আছেন যারা সিলেবাসের যে টপিকগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় কিন্তু পড়তে ও পড়াতে মজাদার সেসব সহজ ও মজাদার টপিকগুলো বেশি বেশি করে বেশি সময় ধরে পড়ান কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কঠিন টপিকগুলো পড়ান না কিংবা পড়ালেও কোনোমতে পড়িয়ে পার করে দেন। এটাকে বলা হয় চকলেট থিওরির টিচিং। এসব টিচার খুব জনপ্রিয় হয়ে থাকেন এবং অবুঝ ছাত্রছাত্রীরাও মুগ্ধ হয়ে তাদের কাছেই আরও প্রাইভেট পড়েও থাকেন। কিন্তু এর ফলাফল ছাত্রছাত্রীরা দেরিতে বুঝতে পারেন। মানবিকের অ্যাডমিশন কোচিং করার সময় বিষয়টা আরও ভালোভাবে দেখেছি। অ্যাডমিশন কোচিংয়ে সময় খুব অল্প থাকে তাই চাইলেও সব টপিক পড়ানো যায় না; কিছু ভাইয়া আছে যারা সিলেবাসের কম গুরুত্বপূর্ণ মজাদার টপিকগুলোই শুধু মজা দিয়ে দিয়ে পড়ান অথচ খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু কঠিন এরূপ টপিকগুলো এড়িয়ে যান কিংবা কোনোমতে পার করেন। পরামর্শের ক্ষেত্রেও এমনটিই ঘটে থাকে। চকলেট থিউরির পরামর্শ শুনে মানুষ খুব মুগ্ধ হয়। ইউটিউব জগৎ তো চকলেট থিউরির পরামর্শে পরিপূর্ণ; সেখানে বাস্তব পরামর্শ খুঁজে পেতে বেশ সময় দিতে হয়। আর শুধু ইউটিউব নয় একটি ফলপ্রসূ পরামর্শ বেছে নিতে একটু সময় যাবেই আর এটাতে অভ্যস্ত হতে হবে।
No comments:
Post a Comment